ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাংবাদিকরা বিচারক নন, আমলারাও প্রশাসক নন



সাংবাদিকরা বিচারক নন, আমলারাও প্রশাসক নন

ঘটনাটা দেড় দশক আগের। বগুড়ার নবাগত ডিসি তার অফিসে এক কাণ্ড ঘটালেন। মিটিং থেকে বের করে দিলেন সরকারদলীয় দু’জন সাবেক এমপিকে। ঘটনার রহস্য উদ্ধার করে নিউজ করলাম দৈনিক সংবাদে। খবর প্রকাশে খেপলেন ডিসি। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের অপমান-অপদস্ত করতে লাগলেন। কিছুদিন পর দেশসেরা এক প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে ঘটালেন আরেক কাণ্ড। 

ক্লাসে ঢুকে শিক্ষিকার ভুল ধরে চরম অপদস্ত করলেন। ভয়ে কেঁদে দিল শিশু শিক্ষার্থীরা। অপমানে কাঁদলেন শিক্ষিকাও। সেই ঘটনা নিয়েও খবর প্রকাশ করায় দ্বিগুণ চটলেন ডিসি। বিষয়টি এমন পর্যায়ে গেল, ডিসি যেখানেই যান গণহারে বানান ভুল ধরেন, আদব-কায়দা শেখান আর সাংবাদিকদের উঠতে বসতে অপদস্ত করেন।

আমরাও ডিসির নিত্যনতুন কাণ্ড নিয়ে খবর প্রকাশ করতে থাকি। তখন ডেইলি স্টারের হাসিবুর রহমান বিলু ভাই ধমক দিয়ে বললেন, ‘ডিসি’কে তুমি ‘জেলা প্রশাসক’ লিখছ কেন? ডিসি কি প্রশাসক? তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মাত্র! বিলু ভাইয়ের কথায় সাহস বেড়ে গেল। ডিসি ইস্যু নিয়ে উঠেপড়ে লাগলাম।

ডিসিও বসে থাকলেন না। ক্ষমতাসীন দলের জেলার শীর্ষ নেতাকে পকেটে ভরলেন। রাজনীতিবিষয়ক দুইটি প্রতিবেদনের জন্য ৫০ কোটি টাকার মানহানি মামলা হলো। তিন মাস ধরে জানপ্রাণ হারানোর আতঙ্কে ভুগলাম। এর মধ্যেই টাউন ক্লাবে হাউজি আয়োজনে ডিসিকে দায়ী করে লিখলাম। এসব কাণ্ডে ডিসি এক পর্যায়ে ডিআইজিকে জানিয়ে এক ওসিকে নির্দেশ দিলেন মামলা দিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করার। ব্যর্থ হয়ে শেষ অবধি নিজেই কোটি টাকার মানহানির আরেকটা মামলা করতে নোটিশ পাঠালেন।

আমাকে সাহস দেয়ায়, পাশে থাকায় বিলু ভাইয়ের নামে চারটি মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা হলো। কয়েক ঘণ্টার জন্য গ্রেপ্তারও হলেন বিলু ভাই। ডিসি অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এরপর জীবনের কত সমীকরণ যে মেলাতে হলো। আইন আর রাজনীতির কত অলিগলি যে জানা হলো, অন্ত নেই। একদিন বিদায়ও জানালাম নিজ জেলাকে।

বিশাল এই ‘শানে নুযুল’ লেখার কারণ হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আর সাংবাদিকদের কাজের পার্থক্য তুলে ধরা। ডিসি বা আমলারা প্রশাসক নন, জনগণের সেবক মাত্র। তাদের অধিকার নেই কাউকে শাসন করার, অপমান করার কিংবা ব্যক্তিগত সম্মান-সম্ভ্রমবোধকে আঘাত করার। প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত ও সুরক্ষা দেয়াই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের একমাত্র কাজ।

আর সাংবাদিকদের কাজ প্রতিটি নাগরিক ও নাগরিক সমাজের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সাংবাদিকরা কখনই প্রশাসক, বিচারক, নেতা, বিশেষ দলের প্রচারক কিংবা মসজিদের ইমাম নন। তাদের অবস্থান জনগণের হয়ে, জনগণের জন্য, জনগণের পক্ষে। কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে তার পক্ষপাতিত্ব করা, ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া সাংবাদিকতা নয়।

তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বেশিরভাগ ‘বড়’ সাংবাদিক এতটাই উর্বর মস্তিষ্কের যে বিশেষ কোনো আদর্শের অনুসারী হয়ে, অন্য আদর্শের সাংবাদিক বা নাগরিকদের সব অধিকার নিমিষেই খারিজ করে দেন। আইন আর সংবিধানের চেয়ে রাজনৈতিক আদর্শের দাস হয়ে রাজনীতিক আর আমলাদের অতি বিনয়ী ‘কামলা’ হয়ে পড়েন। এরপর আমলা আর রাজনীতিকরা যখন এক সুরে কথা বলেন, তখন সাংবাদিকরা গা ঝাড়া দিয়ে বিবৃতি প্রসব করতে থাকেন।

সিনিয়র সাংবাদিক নিয়ন মতিয়ুল’র ফেসবুক থেকে


   আরও সংবাদ