আইএমএফ’র সাবেক উদ্ধতন কর্মকর্তা এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের পুরো আর্থিক খাতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ব্যাংক। শনিবার (১৩ জুলাই) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরাবস্থার কারণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
ইআরএফ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সমকালের বিশেষ প্রতিবেদক ওবায়দুল্লাহ রনি এবং প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন দফতরে চলছে ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি। তবে সবচেয়ে বেশি উল্টাপাল্টা হিসাব দিচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এখানে প্রতিনিয়তই লুকানো হয় খেলাপি ঋণের তথ্য। তারা তথ্য লুকিয়ে ব্যাংক খাতকে স্বচ্চ দেখাতে চাচ্ছে। এ যেনো কার্পেট দিয়ে ময়লা লুকিয়ে রাখার মতো। কিন্তু ময়লা যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে ততই দুর্গন্ধ চড়াচ্ছে। দুর্গন্ধ এখন পুরো আর্থিক খাতে ছড়িয়ে পড়েছে। ময়লা না লুকিয়ে কার্পেটের নিচে ভালোভাবে পরিস্কার করা দরকার। অর্থাৎ ব্যাংক খাতে অনিয়ম, ঋণ খেলাপি আর দুর্নীতি না লুকিয়ে এর লাগাম টানা দরকার।
ব্যাংকে গ্রাহকের আমানত সুরক্ষার বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংক খাত এখন নিজেকেই নিজে রক্ষা করতে পারছে না, গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা দিবে কি করে? ইসলামী ব্যাংক খেলাপি ঋণকে পুনঃতফসিল দেখিয়ে নিজেদের ভালো অবস্থান প্রমাণ করতে চাচ্ছে। এ জন্য সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। অথচ এসব টাকা ব্যাংকের কাছে নেই, তা খেলাপি হয়ে গেছে আরও আগেই। আসলে আমরা ‘ঘরের থালাবাসন বেঁচে কোরমা পোলাও খাচ্ছি।’ এভাবে আর কতদিন ব্যাংক চলবে? অমানত একটা সময় শেষ হয়ে যাবে। এতে গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না ব্যাংক। এখন আর্থিক খাতের 'ক্লিনিং' কার্যক্রম প্রয়োজন। অথচ এখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। এদিকে ব্যাংকখাতের আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী, কিছু কিছু পরিবার। সরকারের আর্শিবাদের তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারবে না দেশের ব্যাংক খাত।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে আার্থিক দূরবস্থার কারণে দিন দিন ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছে দেশ। ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে দেশের। তিনি বলেন, সরকার বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজানীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই আমাদের। কিভাবে বাস্তবায়ন হবে। দেশের আর্থিক খাতের সংকট মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।
ড. আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আমাদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দুই বিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তাহলে তার ভার বহনও করা যায় না। ব্যাংক খাতের দুর্বলাতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাতকেও ঋণ দিতে পারছে না। আবার সরকার ঋণ দিতে পারছে না, সরকার পারবেও না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। চলতি বছর যদি বাড়ে তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সে হিসাবে এবছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকখাত থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কিভাবে দিবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে না। আবার বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগা ২২ থেকো ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরাফেরা করছে। ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি যদি না বাড়ে, সরকারকে যদি ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জন হবে?
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। ছয় মাস পার হয়ে গেলেও সংস্কারের কিছুই হয়নি। এটা হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই ব্যাংক খাতের সংস্কার জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, এটাকে ভালো চোখেই দেখি। কিন্তু আমাদে নিজেদের স্বার্থেই ব্যাংখখাত সংস্কার করা দরাকার। আমরাতো ব্যাংকের আমানত খেয়ে ফেলছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে স্বেতপত্র প্রকাশ করা দরাকার। সেটা সরকারকেই করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকের এই অবস্থার কারণ আমাদের খুজে বের করতে হবে।
প্রবন্ধ উপস্থানকালে ইআরএফ-র জেষ্ঠ্য সদস্য ওবাইদুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব জানান, বর্তমান সরকারের সময়ে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো অনেক বড়-বড় প্রকল্প হয়েছে। এসব প্রকল্পের সুফল হিসেবে যেখানে কর্মসংস্থান বেড়ে মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে থাকার কথা। তবে ডলার সঙ্কট, ব্যাংক খাতে দূরবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীত এবং ব্যাংক খাতের দূরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃংখলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতি সহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে মেয়াদি ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় এবং ৯-৬ এর মতো নীতি গ্রহণ করে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরস্থিতি এবং ব্যাংক খাতে বিশৃংখলার বিষয়টি সবার জানা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কাজে ব্যর্থ হয়েছে বলে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বলেছেন। আবার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে। সর্বশেষ সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত ১৩ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
তারা বলেন, দেশে উচ্চ মল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮৪-৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। তবে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর তা আর ধরে রাখা যায়নি। শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উপায়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ২০২২ সালের আগস্টে কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেডকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমডিদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এরপর ব্যাংক খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার বাজার আরও খারাপ হয়। ডলারের দর উঠে যায় ১১০ টাকায়। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার প্রভাবে টানা দু'বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। আবার ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮.০৬ বিলিয়ন থেকে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে নেমেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ ডলার সঙ্কট। অথচ অর্থপাচারকারী, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।