উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করে আস্থা আর ভরসার প্রতীক হয়ে উঠলেও শুধু আস্থাহীনতার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশীয় বীমা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম। পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ না করায় চরম আস্থাহীনতায় গ্রাহক হারাচ্ছে দেশীয় বীমা কোম্পানিগুলো। যেকারণে বীমা খাতের আওতাও বাড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ বীমা কোম্পানি কালক্ষেপণের দায় কৌশলে গ্রাহকের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। যে কারণে এ খাতে প্রতিনিয়তই সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। সঙ্কট কাটাতে কোম্পানিগুলো বিমা দাবির অর্থ যাতে সময়মতো পরিশোধ করে, সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কঠোর হতে হবে বলেও মত দেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, উচ্চ কমিশনের বিনিময়ে প্রিমিয়াম সংগ্রহ, কম পুনর্বীমা, দেরিতে দাবি নিষ্পত্তি, অন্যায্য প্রভাব, দুর্বল জনশক্তির মান, পরিচালন দুর্বলতা, ব্যাংকারদের কমিশন বাণিজ্য, সার্ভেয়ারদের মনগড়া সার্ভে এবং বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এ খাত অগ্রসর হতে পারছে না। প্রবাসী শ্রমিক রেমিট্যান্স প্রেরণকারী থেকে কৃষিজীবীসহ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনও বীমা আওতার বাইরে রয়ে গেছে। কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি, দারিদ্রতা, শিক্ষায় পাশ্চাদপদতা এবং সচেতনতার অভাব এই শিল্পখাত বিকাশে প্রধান অন্তরায় বলেও মনে করছেন তারা।
বীমা শিল্প বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্পখাত। মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বীমার গুরুত্ব ব্যাপক ও অপরিসীম। বিশ্বের মধ্যে বীমা শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। বলতে গেলে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বীমা শিল্প খুবই নগণ্য যা দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মাত্র। এখানে মাথাপিছু বীমা ব্যয় কেবল ২ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। জিডিপি অনুপাতে বীমা প্রিমিয়াম দাঁড়িয়ে আছে মাত্র দশমিক ৯ শতাংশে। এর মধ্যে দশমিক ৭ শতাংশ জীবন বীমা এবং বাকি দশমিক ২ শতাংশ সাধারণ বীমা। যেখানে পার্শ্ববর্তী বিশাল জনসংখ্যার দেশ ভারতে বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৬০টি সেখানে ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে সেবা দিচ্ছে ৭৯টি বীমা কোম্পানি। এ কোম্পানীগুলোর মধ্যে ৩৩টি লাইফ বীমা এবং ৪৬টি নন লাইফ বীমা কোম্পানি। লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যে একটি সরকারি এবং ৩২টি বেসরকারি মালিকানাধীন। অন্যদিকে নন লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যে একটি সরকারি এবং ৪৫টি বেসরকারি মালিকানাধীন। বাংলাদেশের বাজারের আকৃতি অনুযায়ী নিবন্ধিত বীমা কোম্পানির এ সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। সাধারণ বীমার ৩৬ শতাংশই শীর্ষ চার কোম্পানি বা করপোরেশনের দখলে। জীবনবীমা নিয়ন্ত্রিত হয় বিদেশি কোম্পানি মেটলাইফ আলিকো দ্বারা। সাধারণ বীমার বাজার শাখা চালিত। অন্যদিকে জীবন বীমা এজেন্ট চালিত। কিছু জীবনবীমা কোম্পানি পল্লী বা মফস্বল এলাকায় নিজেদের অনেক শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন প্রবর্তিত অধিকাংশ শাখা টিকে থাকার লড়াই করতে করতে এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। কতদিন এ লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে সেটি এখন দেখার বিষয়।
সারমিন বেগম নামে লক্ষ্মীপুরের এক গ্রাহক ২০০৬ সালে একটি কোম্পানীতে ১০ বছর মেয়াদী বিমা করেন। ২০১৭ সালের শুরুতে মেয়াদ শেষ হলেও দীর্ঘ আড়াই বছরেও বিমা দাবি বুঝে পাননি। অফিসে গেলে নানা অজুহাত দেখিঢে হয়রানী করা হয় তাকে। প্রায় তিন বছর পর জানতে পারেন তার বিমা দাবীর টাকা অফিসের কর্মকর্তারা তুলে নিয়ে গেছেন বহু আগে। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় টাকা বুঝে পান তিনি।
প্রাইম ইন্সুরেন্স কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্ট নুর-উল-আলম বলেন, বীমা দাবী পরিশোধে ভোগান্তির কারণে বীমার প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। যেকারণে বীমা কোম্পানীগুলো অগ্রসর হতে পারছে না। আস্থাহীনতার মূল কারণ হচ্ছে সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ করতে না পারা। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ তা হচ্ছে আইডিআর’র সীমাবদ্ধতা। তাদের নিজস্ব তেমন কোন জনবল নেই। যে কারণে তারাও সমস্যা সমাধানে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে এর বাইরে কিছু কিছু বীমা কোম্পানী ভাল করছে। যে কারণে এখনও দেশে বীমা কোম্পানীগুলো টিকে আছে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশ ছোট ও অসংগঠিত কোম্পানীর পরিচালনা ক্রমেই কঠিন হবে। বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ কিংবা অন্য একই ধরনের দেশে যা ঘটছে, তা বিবেচনায় নিলে আমাদের বীমা খাতের আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর চেয়ারম্যান বদরুল আলম খান বলেন, জনগণের সচেতনতার অভাব, বিদেশি কোম্পানীর প্রতি আগ্রহ, বীমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করা ইত্যাদী নানাবিধ কারণে এদেশে এখনও বীমার ব্যাপক বিস্তার ঘটেনি। তবে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপকতার কারণে ইদানিং বীমার ব্যাপকতা কিছুটা বাড়ছে। এছাড়াও বীমা দিবস পালন, জনগণের মধ্যে প্রচার ও প্রসারের জন্য বীমামেলার আয়োজন বীমাশিল্পে ব্যাপকতা এনেছে।
আইডিআরএ এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রামের গরিব মানুষ খুব কষ্ট করে টাকা জমা দিয়েছে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও কিছু কিছু কোম্পানি পলিসির টাকা না দিয়ে বিভিন্ন ভাবে গ্রাহককে হয়রানি করছে। আমরা প্রতিটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে কঠোর বার্তা দিয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথাও জানান তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বীমাখাতকে এগিয়ে নিতে হলে গ্রাহকের স্বার্থ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বীমা দাবি পরিশোধের বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন তারা।