ঢাকা, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১০ রবিউল সানি ১৪৪৬

স্বপ্নপূরণ ইউরোপে, ভঙ্গ মধ্যপ্রাচ্যে



স্বপ্নপূরণ ইউরোপে, ভঙ্গ মধ্যপ্রাচ্যে

মেহরাব ইমরান আকিব

কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আইনজীবী, কেউবা আবার উচ্চশিক্ষার জন্য চায় স্কলারশিপ। প্রত্যেক ছাত্রেরই আলাদা একটা স্বপ্ন থাকে। তারা স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। একটা সময় এসে কারো স্বপ্ন পুরন হয়, পৌঁছে যায় কাঙ্খিত লক্ষ্যে। কারো স্বপ্ন হারিয়ে যায় মাঝ পথে। কেউবা স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে নিজেকে। কারো উপর চেপে বসে পরিবারের দায়িত্ব। দায়িত্বভার নিতে গিয়ে অনেকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। তবুও তারা সবকিছু মেনে নেয় হাসিমুখে। চালিয়ে যায় জীবন সংগ্রাম। ছুটে চলে অনন্ত অসীমের পথে।

বর্তমানে ছাত্রসমাজের চোখের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় সমাজব্যবস্থার করুণ পরিণতি। অথচ তাদের চোখেই দেখার কথা ছিলো আগামীর উন্নত বিশ্বের রুপরেখা। কিন্তু উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতে গেলেই তাদেরকে পড়তে হয় বিপত্তির মাঝে। লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্নিল চোখে থাবা বসায় দুঃস্বপ্নের কালো ছায়া। নেমে আসে অর্থনৈতিক সংকট। কাধে ভর করে দায়িত্বের ভার। জলে ভাসে স্বপ্নভরা দুচোখ। মেনে নিতে হয় প্রবাস জীবনের অন্ধকার ছায়া। দায়িত্বের ভারে নুয়ে পড়ে এসব মেধাবী ছাত্ররা।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করছে হাজারো ছাত্র। তেমনই একজন চাঁদপুরের মিরাজ হোসেন। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। মিরাজের স্বপ্ন ছিল ব্যাংকার হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। অনার্স ২য় বর্ষ শেষ করা হয়নি তার। জীবিকার তাগিদে ২০১৪ সালে চলে যেতে হয়েছে মালয়েশিয়ায়। 

দুঃখ্য ভারাক্রান্ত মনে মিরাজ দেশখবরকে বলেন, খুব ইচ্ছে ছিলো একজন ব্যাংকার হবো। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্যেও সে স্বপ্ন পুরন হয়নি। হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের অয়ের পথ। সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। কেনোরকম টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছিলেন মা। কিন্তু মায়ের পক্ষেও আর একা সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন আমরা দুই ভাই পড়াশোনা করছিলাম। একসাথে দুজনের পড়ার খরচ বহন করতে পারছিলেন না মা। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে আমাকে। সব স্বপ্ন পাথর চাপা দিতে হয়েছে। পাড়ি দিতে হয়েছে বিদেশে। তিন বছর কাটিয়েছি মালয়েশিয়ায়। এরপর দেশে যাই। ভেবেছিলাম হয়তো কিছু একটা ব্যাবস্থা হবে কিন্তু হয়নি। তাই আবারো ছুটতে হলো সেই একই পথে। চলে আসলাম সৌদি আরব। যার স্বপ্ন ভাঙে কেবল সেই জানে এর যন্ত্রণা কতটা, তারপরও পরিবারের সুখের জন্য মেনে নিয়েছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওমান প্রবাসী বলেন, ইচ্ছে ছিলো আইনজীবী হবো। এখন দিনমজুরের কাজ করছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম আমি। ৩য় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার সুযেগ হয়েছে। তবে ফাইনাল পরিক্ষা দেয়া হয়নি। স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। কোনোভাবে জীবন পার করতে পারলেই বাঁচি এখন। মাঝে মাঝে মনে হয় কেনইবা পড়াশোনা করতে গেলাম। ছোটবেলা থেকেই যদি কাজে লেগে যেতাম, তাহলে আর এতো কষ্ট পেতে হতো না। যাইহোক পরিবারের জন্যই সব ত্যাগ করেছি। প্রবাসে এসে দিনমজুর হয়েছি কিন্তু পরিবার জানে খুব সুখেই আছি। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের স্বপ্ন দেখতে নেই। এছাড়াও, আমিরাত প্রবাসী ফয়সাল, কুয়েত প্রবাসী জাবেদ, কাতার প্রবাসী জাহিদের মতো হাজারো ছাত্রের গল্পটা একই। কেউ ছেড়েছে অনার্স ১ম কিংবা ২য় বর্ষ, কেউবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই ছাড়তে হয়েছে। কেউ কেউ উচ্চমাধ্যমিক ১ম বর্ষেই ছাড়তে হয়েছে।

বিপরীত চিত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে কিছুটা স্বাবলম্বী পরিবারে বেড়ে ওঠা ছাত্রদের। তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমায় ইউরোপের দেশগুলোতে। তাদেরই একজন লিথুয়ানিয়া প্রবাসী ছাত্র দ্বীপ দেব। দ্বীপ দেশ খবরকে বলে- আমার স্বপ্ন ছিলো ইউরোপের কোনো একটি দেশে পড়াশোনা করবো। এ জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি। চেষ্টা চালিয়েছি প্রতিনিয়ত, IELTS করেছি, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। অবশেষে স্বপ্ন পুরন করন করতে পেরেছি। আজকে আমি লিথুয়ানিয়ার কাউনাস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একজন ছাত্র। দ্বীপ বলেন, আমার চেষ্টার পাশাপাশি পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছি। যেকারণে নিজের স্বপ্ন পুরন করতে পেরেছি। এখন পড়াশোনা ভালোভাবে শেষ করতে পারলেই আমার ও পরিবারের পরিশ্রম সার্থক হবে।

রোমানিয়া থেকে রাহাত ইভান দেশখবরকে বলেন, চেষ্টা করেছি তাই সফল হয়েছি। শুধু নিজের পরিশ্রমেই কাজ হয় না, আর্থিকভাবেও কারো না কারো সাপোর্ট লাগে।  স্বপ্ন পুরন করতে পরিবারের সাপোর্ট লাগে, যেটা আমি পেয়েছি। আজকে আমি Babeș-Bolyai University,Cluj-Napoca, romania'র একজন ছাত্র। ৬ মাস ধরে এখানে আছি ভালোই সময় কাটাচ্ছি।

একটু স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা যেমম প্রবাসী হয় ছাত্র হিসেবে উচ্চশিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন পুরন করতে তেমনি মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা প্রবাসী হয় ছাত্রত্ত ত্যাগ করে স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে ভালো রাখতে। তাই বলা যায় ছাত্রদের স্বপ্নপূরণ হয় ইউরোপে আর ভঙ্গ হয় মধ্যপ্রাচ্যে।


   আরও সংবাদ