জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ঘোষিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ দ্য ভিকটিম্স অফ এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ বা ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস’ পালিত হয়ে গেল ৩০শে আগস্ট। জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে দিবসটি পালনের জন্য সদস্য সব দেশগুলোকে আহ্বান জানালেও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভের অনেক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনে দিবসটি উদ্যাপন করে আসছে। গুম ‘কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চেয়েও বড়’ অপরাধ মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। এ বিষয়ে সংস্থাটির মহাসচিবের মূল বক্তব্য হচ্ছে ‘এক্ষেত্রে দায়মুক্তি যন্ত্রণা আর হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে সত্য জানার অধিকার রয়েছে (সংশ্লিষ্ট) পরিবার এবং সমাজের। আমি সদস্য দেশগুলোকে উক্ত দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাই।’
এ বছর দিবসটি উপলক্ষে বেশ কড়া বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনও। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘গুম আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভিন্নমতকে নীরব করতে এবং সুশীল সমাজকে আক্রমণে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর জন্য যারা দায়ী তারা প্রায়ই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা মানতে অস্বীকার করে। এমনকি সন্ত্রাস বিরোধী কার্যকলাপের অজুহাত দিয়ে তাদের হত্যাও করতে পারে। কর্তৃত্ববাদী শাসক এবং তাদের লোকজন মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, পরিবেশ রক্ষাকারী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠী যেমন শিশু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিখোঁজ করে ভয়ের সংস্কৃতি চালু এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র গুম ঠেকাতে নিজ প্রতিশ্রুতি ফের ঘোষণা করছে এবং বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে এর অবসান ঘটাতে, দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে, নিখোঁজ হওয়া প্রিয়জনের হদিস বা তাদের সঙ্গে কী হয়েছে তা জানাতে এবং সকল ব্যক্তির মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানাতে আহ্বান জানাচ্ছে।’
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরে এসে জোরপূর্বক গুমের অভিযোগগুলো নিয়ে গভীর তদন্তের আহ্বান জানিয়ে গেছেন। তার সে আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। গুম নিয়ে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের যখন এমন কড়া অবস্থান, যখন দেশে দেশে মানুষ গুমের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে; তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইনে ঘটেছে এক চমকপ্রদ ঘটনা। মাস কয়েক আগে দেশটিতে এমন একজন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন যার পিতার বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষকে গুম করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে।
একটু পেছনে ফিরে তাকালেই আমাদের সেটি বুঝতে সুবিধা হবে। গত মে মাসে ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ভূমিধস জয় পান ফার্দিনান্দ মার্কোস (জুনিয়র), যিনি বংবং নামেই সমধিক পরিচিত। জুন মাসে আগামী ছয় বছরের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। বংবং দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী ফার্দিনান্দ মার্কোস (সিনিয়র) এর একমাত্র পুত্র। আইনজীবী, শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদ মারিয়ানো মার্কোসের (বংবং এর দাদা) পুত্র মার্কোস সিনিয়র ছিলেন নিষ্ঠুর এক স্বৈরশাসক যিনি ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২১ বছর দেশ শাসনের পর ১৯৮৬ সালে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতচ্যুত হয়েছিলেন। তার স্বৈরাচারী শাসনামলে ফিলিপাইনে মানাবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন ও সীমাহীন দুর্নীতির নজির স্থাপিত হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, নির্যাতন আর দেশছাড়া করার পাশাপাশি তিনি অসংখ্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুম করেছিলেন। সাধারণ মানুষ এবং বিরোধীদের উপর চরম নির্যাতন ছাড়াও মার্কোস সিনিয়র দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছিলেন। তাকে ওই সময়ে পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তার স্ত্রী ‘কুখ্যাত ফার্স্ট লেডি’ বলে পরিচিত ইমেল্ডা মার্কোসের কোটি কোটি টাকার অসংখ্য বিলাসবহুল জুতা সংগ্রহের কথা আরব্য রজনীর কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। মূল কথায় আসি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মার্কোস সপরিবারে দলবলসহ লাখো কোটি টাকা ও সম্পদ নিয়ে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ভাগেন। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে মার্কোসের ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কথা শোনা গেলেও তারা হাওয়াইতে একরকম আবদ্ধ জীবনযাপন করছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে তার বিরুদ্ধে শত শত মামলা দায়ের করা হয়। মানসিক চাপে তিনি বারবার মার্কিন প্রশাসনের হাত-পা ধরেন। এর মধ্যেও অবশ্য শপিং করা, পার্টি আর ফূর্তি করা থেমে ছিলনা। মাঝখানে বিভিন্ন ছলচাতুরি করে বিদেশ থেকে ফের ফিলিপাইনের ক্ষমতা নিতে চাইলেও ব্যর্থ হন মার্কোস। পলাতক জীবনের কিছুদিন বাদেই (১৯৮৯) তিনি নিউমোনিয়াসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর আগে ফিলিপাইনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সালভাদোর লরেল তাকে দেখতে গেলে তিনি অবৈধ উপায়ে অর্জিত নিজ সম্পদের ৯০ শতাংশ ফিলিপাইনের জনগণকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু, শর্ত জুড়ে দেন এর বিনিময়ে তাকে ফিলিপাইনে নিজ মায়ের পাশে সমাহিত করতে হবে। এখানে লক্ষণীয়- যে মানুষটির (গুম করার) কারণে অগণিত পরিবার তাদের প্রিয় মানুষের লাশটি পর্যন্ত দেখতে পায়নি, সে মানুষটিই মৃত্যুর আগে নিজ দেশে নিজ মায়ের পাশে কবরের জন্য খুব আকুতি-মিনতি করেছিলেন। যাই হোক, ফিলিপাইনের তৎকালীন সরকার মার্কোসের ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কদিন বাদে যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুতে তিনি মারা যান। ফিলিপাইন সরকার তার মরদেহ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। মারা যাওয়ার ৪ বছর পর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসলে তার মরদেহ নিজ দেশে নেয়া হয়। জনতার প্রতিবাদে তার মরদেহ সমাহিত করা নিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়।
মার্কোসের মৃত্যুর পর ১৯৮৯-১৯৯৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তার এবং তার কন্যা ইমির বিরুদ্ধে গুম, হত্যা, নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আনা হয়। মার্কোসের অবৈধ সম্পদ থেকে পরবর্তীতে ফিলিপাইন সরকার নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। ২০১৮ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ১১,১০৩ জন এমন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। এছাড়াও মার্কোসের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হিসাবে স্বীকৃত পাননি এমন হাজার হাজার লোককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার একটি প্রস্তাব ফিলিপাইন সংসদে ২০২০ সালে পাস হয়েছে। সম্প্রতি, ফিলিপাইনে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘FIND’ জানিয়েছে, মার্কোস সিনিয়রের একনায়কত্বের সময় থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে ২,০৪৬টি গুমের ঘটনা ঘটেছে যাদের অর্ধেকেরও বেশি (১,২০৪ জন) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন, ২৪৮ জনের লাশ বা কবর পাওয়া গেছে এবং ৫৯৫ জন জীবিত ফিরে এসেছেন। গুম হওয়া ২,০৪৬ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই (৯২৬ জন) মার্কোস সিনিয়রের সময়ে সেনাবাহিনী বা পুলিশ দ্বারা গুম হয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। এসবের বাইরে, ফিলিপাইনের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পর মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ১২,০০০ মানুষকে হত্যার পাশাপাশি অনেককেই গুম করা হয়েছিল বলে ব্যাপক ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। দ্যা ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিং (আইডাব্লিউপিআর) জানাচ্ছে, এখন ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে বংবং দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে দেশটিতে গুমের কারণে ভুক্তভোগী হাজার হাজার নাগরিক খুব একটা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করছেন না।
নতুন প্রেসিডেন্ট তার পিতার স্বৈরাচারী শাসনকে কেন্দ্র করে নিজের পরিবারের প্রতি জনসাধারণের মধ্যে যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে সেটি ঠিক করতে কাজ করবেন বলে কেউ কেউ মনে করলেও তারা এই নিয়ে সতর্ক যে দেশে মানবাধিকারের রেকর্ড বাড়ানোর ক্ষেত্রে তার আগ্রহ সীমিত। গুম হওয়া এক মেয়ের মা (বর্তমানে মানবাধিকারকর্মী) আইডাব্লিউপিআরকে বলেন, ‘মানবাধিকারকর্মীদের রাষ্ট্রের শত্রু জ্ঞান করার দিক দিয়ে দেখলে প্রেসিডেন্ট তার স্বৈরশাসক পিতার চেয়ে ভিন্নকিছু হবেন না।’ অবশ্য ওই নারীর এমনটি মনে করার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। পূর্বসূরী প্রেসিডেন্ট দুতার্তের থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বারবার অনুরোধের পরও মার্কোস জুনিয়র প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে জুলাই মাসে প্রথম যে ভাষণ দেন সেখানে মানবাধিকারকে তার নীতিগত অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেননি। জাতিসংঘ বলছে, গুমের ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অমীমাংসিত রয়ে যাওয়ার দিক থেকে ফিলিপাইন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একেবারে শীর্ষে অবস্থান করছে। এ অঞ্চলে এ ধরনের ঘটনার প্রায় অর্ধেকই (১,৩০০) ফিলিপাইনে রেকর্ড করা হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বারবার বলা সত্ত্বেও ফিলিপাইন এখন পর্যন্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ নামক আন্তর্জাতিক কনভেনশনটি (সনদ) রেটিফাই (গ্রহণ) করেনি। প্রসঙ্গত, কোনো রাষ্ট্র বা তার সংস্থাগুলো ব্যাপকভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গুমের ঘটনা ঘটাতে থাকলে উক্ত সনদ গুমকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে গণ্য করে। এখন পর্যন্ত, কম্বোডিয়া হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ যেটি এই সনদ গ্রহণ করেছে। এ অঞ্চলের তিন দেশ- ইন্দোনেশিয়া, লাওস এবং থাইল্যান্ড সনদটিতে স্বাক্ষর করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে জাতিসংঘ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদটি রচনা করে যেটি ২০১০ সাল থেকে কার্যকর হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের মোট ৬৮ দেশ সনদটি গ্রহণ করেছে। মোট ৯৮টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সনদটি গ্রহণ করেনি।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেইলঃ choyon_du05@yahoo.com