ঢাকা, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১০ রবিউল সানি ১৪৪৬

নদী ছাড়া সেতু হয়, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হয় না!



নদী ছাড়া সেতু হয়, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হয় না!

‘জনাব, বিনীত নিবেদন এই যে, শাহরাস্তি উপজেলার অধীনে চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের অন্তর্গত মুনিপুর এবং কৃষ্ণপুর গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে ডাকাতিয়া নদী অবস্থিত, যেখানে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। কিন্তু, এই নদীতে কচুরিপানা বেড়ে গেলে নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, এলাকায় এক লাখ লোকের বসবাস। অত্র এলাকায় জনগণের দুর্ভোগ উপশমের নিমিত্তে উক্ত নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য আপনার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।’ ২০২২ সালের আগস্ট মাসে কৃষ্ণপুর গ্রামবাসীর পক্ষে চাঁদপুর জেলার ৫ নং সংসদীয় আসনের (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের কাছে এমন আবেদন করেছিলেন ওই এলাকার অধিবাসী, সুবেদার মেজর (অব.) শরীফ উল্ল্যাহ পাটোয়ারী। তার সঙ্গে আবেদনকারী হিসেবে আরও ছিলেন মনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি, সহ-সভাপতি এবং কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এরইমধ্যে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আবেদনটির বিপরীতে কোনো জবাব তারা পান নি। লাখখানেক লোকের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য আবেদন করে লেখা ওই চিঠির জবাব না দেয়া হলেও দেশে এমন অনেক সেতু আছে, যেখানে কোনো নদী-ই নেই! এ ধরনের খবর প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। 

২০১৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনের  ‘সেতু আছে, নদী নেই’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘দিনাজপুরের কাহারোলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের খরস্রোতা পুনর্ভবা নদী ও সদরের গাবুরা উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আত্রাই নদী প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ড্রেজিংয়ের অভাবে যেন মরা খাল। দিন দিন নদী দু’টি নাব্য হারিয়েছে। তবে শুধু পুনর্ভবা কিংবা আত্রাই নদী নয়, এই অবস্থা আরও অনেক নদীতে।

ফলে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সেতু আছে, কিন্তু নদী নেই।’ এ ছাড়াও দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেখানে আড়াআড়িভাবে সেতু ছাড়া সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সড়ক সেতু আছে, সংযোগ সড়ক নেই, নদীমাতৃক বাংলাদেশে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। ২০২২ সালের ৫ই ডিসেম্বর দেশ রূপান্তরের ‘সেতু আছে, সড়ক নেই’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার নাংলা ইউনিয়নের বন্ধরৌহা এলাকায় কাটাখালী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এক বছর আগে সেতুটি নির্মাণ করে। তবে সেতুটির দুই পাশে চলাচলের জন্য কোনো সড়ক না থাকায় জনসাধারণের কোনো কাজেই আসছে না।’ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি ১৪ দৈনিক জাগরণের (সেতু আছে, রাস্তা নেই) প্রতিবেদনে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের কালী নদীর একটি সেতু প্রসঙ্গে লেখা হয়, ‘ইট, পাথর আর সিমেন্টের তৈরি শক্ত সেতু দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু নেই সেতুর দুই পাশের সংযোগ রাস্তা।

তাই বাধ্য হয়ে বাঁশের তৈরি সাঁকো দিয়েই নদী পার হতে হয় এলাকাবাসীর।’ এ ছাড়া অনেক অপরিকল্পিত সেতুও রয়েছে, যেগুলোতে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না।  নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ (২০২২ সালের ১৪ই মার্চ) প্রথম আলোতে লিখেছিলেন, ‘এমন নদী খুব কম আছে, যেখানে নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট করে সেতু নির্মাণ করা হয়নি। সেতু নির্মাণ করার সময় বিদ্যমান নদী কিংবা সিএস নকশা অনুযায়ী নদীর  কোনোটিকেই আমলে নেয়া হচ্ছে না। রংপুরের বুড়াইল, বাইশাডারা, শ্যামাসুন্দরী, খোকসা ঘাঘট, ঘাঘট, শালমারা, আলাইকুমারী নদ ও নদীতে প্রস্থের চেয়ে ছোট করে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পাবনার ইছামতি নদীর উপর প্রায় অর্ধশত সেতু আছে, যার প্রতিটি নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট করে নির্মাণ করা। বলা যায়, দেশের সর্বত্রই অভিন্ন অবস্থা।’ এত লেখালেখির পরও কোনো কিছুই থেমে নেই! সেতু নির্মাণে দুর্নীতি চলছেই। অতি সমপ্রতি (১৭ই ডিসেম্বর, ২০২২) কালের কণ্ঠের ‘নির্মাণ ব্যয় পাঁচ কোটি টাকা, সেতুতে উঠতে হয় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির তারাবুনিয়া খালের উপর নির্মিত সেতুতে সংযোগ সড়ক না থাকায় কাঠের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে সেতু পার হয় মানুষ।

উপজেলার মিয়ারহাট বন্দর থেকে নান্দুহার বাজার হয়ে বানারীপাড়া উপজেলায় যাতায়াতের জন্য জনগুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কের তারাবুনিয়া খালের উপর চার কোটি ৮৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪৬ মিটার গার্ডার ব্রিজটি নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ।’ সেতু নিয়ে আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে পদ্মা সেতুর নাম। গত বছরের ২৫শে জুন বহুল প্রতীক্ষিত, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই সেতুটির উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের দিন যত ঘনিয়ে আসছিল ততোই সেতুটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও বাড়ছিল। সেতুটি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারও মনেই কোনো সন্দেহ ছিল না। বরং, এই সেতুটি নির্মাণ করা ছিল অত্যাবশ্যক। কিন্তু, সেতুটি নিয়ে সমালোচনার বড় একটা জায়গাজুড়ে ছিল এটির নির্মাণ ব্যয়। ১৪ই জুন ২০২২, বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অনেকটা পদ্মা সেতুর মতোই প্রতিবেশী দেশের অন্য সেতুর সঙ্গে তুলনায় দেখা যায় এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় হয়েছে অনেক বেশি। পদ্মা সেতু নির্মাণে এত বড় অঙ্কের অর্থ খরচের কারণ কী? সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে কেন এ সেতুর খরচ এত বেশি। তবে বিভিন্ন পক্ষ থেকে উঠেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তা বন্ধ করে দেয়া হয়।’ উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ পড়েছে প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার। কিন্তু, ২০০৭ সালে এর অনুমিত খরচ ধরা হয়েছিল ১১৬ কোটি ডলার। এসব বিষয়ে শুধু যে দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সচেতন মহলই নজর রাখছেন তা নয়, বিদেশি কূটনীতিক এবং উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুদেরও এগুলো নজর এড়ায় নি। গত সোমবার (২৩শে জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তব্য  রাখছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদলের প্রধান চার্লস হোয়াইটলি। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশংসা করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু এবং চট্টগ্রাম টার্মিনালের মতো অনেককিছুই হচ্ছে যেগুলো ব্যবসার জন্য ভালো। কিন্তু অবশ্যই দুর্নীতির মতো ইস্যুগুলো রয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এর আগেও রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন বক্তব্যে দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান যে ১৪৭ নম্বরে সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এলডিসি উত্তরণের পর জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে দুর্নীতি বন্ধ সহ বিভিন্ন খাতে নজর দিতে বলেছিলেন।

আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের অনাবাসী সিনিয়র ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ এ বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলো- এগুলো কোনো ব্যতিক্রম নয়। এটাই ধারা।’ তিনি হংকংভিত্তিক বিখ্যাত ইংরেজি সংবাদপত্র সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর মতো কিছু অবকাঠামো প্রকল্পের প্রয়োজন আছে, কিন্তু পর্দার আড়ালে যেভাবে সেখানে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এবং টেকসই নয় এমন প্রকল্পগুলোর সংখ্যাই প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়।’ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, শুধু পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পই নয়, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করে: ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে খরচ হচ্ছে ১২৬৫ কোটি ডলার। কিন্তু এই প্রকল্প এখনো কমিশন্ড না হওয়া পর্যন্ত এর প্রকৃত খরচ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। পানির নিচ নিয়ে কর্ণফুলী টানেলের মূল খরচ ধরা হয়েছিল ৮০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। কিন্তু, তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩ কোটি ডলারে। এককথায় বলা চলে, বেশির ভাগ মেগা প্রকল্প ঘিরেই বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, এই সেদিনও (৯ই ডিসেম্বর, ২০২২) আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উপলক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, দুর্নীতি আর উন্নয়ন একসঙ্গে চলতে পারে না। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ যে দলের হোক, দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে- এটা নিশ্চিত করতে হবে। আদালতও অনেকবার বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেয়া হবে না। কিন্তু, দুর্নীতি বন্ধ হওয়া বা কমাতো দূরে থাক আরও বেড়েছে বলেই সকলের ধারণা। এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি- দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিজেরাই দুর্নীতিবাজ কিনা সেটিই আগে নির্ধারণ করতে হবে।


   আরও সংবাদ