ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০১ জানুয়ারী ২০২৬, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২, ১২ রজব ১৪৪৭

অর্থনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার সাফল্য!



অর্থনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার সাফল্য!

গৃহবধু থেকে রাজনীতির মাঠে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন নেত্রী হয়ে ওঠেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বৈরাচার হটিয়ে প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই অর্থনৈতিক সংস্কারে হাত দেন। তার এই সংস্কারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল অবধি, যখন তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী। বেগম জিয়ার উদ্যোগগুলো দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেয়। এর উপর দাঁড়িয়েই পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

১৯৯১ সালে বেগম জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আর্থিক খাতে সংস্কার, ভ্যাটের মত যুগান্তকারী ব্যবস্থা চালু, শিল্প উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ, রপ্তানি বাড়াতে নীতি সহায়তা, জনশক্তি রপ্তানিতে নতুন বাজার খোঁজা মধ্য দিয়ে দেশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে রূপান্তরের উদ্যোগ নেন। সেই সঙ্গে আর্থিক খাতে ফিরিয়ে আনেন শৃঙ্খলা। শিক্ষার প্রসার বিশেষ করে নারী শিক্ষার উন্নয়নে চালু করেন উপবৃত্তি।

অর্থনীতিতে নেয়া সংস্কারের ফলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছিল গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ। সংস্কার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়েও খালেদা জিয়ার তৃতীয় মেয়াদেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের মাইল ফলক অর্জন করে। জিডিপি বাড়ায় দারিদ্রের হারও কমে যায়।

বিগত সরকারের অন্যতম সমালোচিত ইস্যু ছিল আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা ও বিদেশি ঋণের বোঝা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার হাত ধরে যে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজুদ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বেগম জিয়া তা অব্যাহত থাকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এর ওপর দাঁড়িয়েই বিগত সরকার প্রচুর দেশি-বিদেশি ঋণ নেয়ার সুযোগ পায়। যার পরিমাণ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, জিডিপির ৩৮ শতাংশের বেশি। এই ঋণের বোঝা দুইটি বাজেটের চেয়ে বড়।

ঋণ ও বিদেশি সাহায্য নির্ভর বাজেট থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সরকারের স্বনির্ভরতার জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ তথা রাজস্ব বাড়ানোর দিকে নজর দেন। এর অংশ হিসেবেই ১৯৯১ সালে দেশে প্রথমবারের মত চালু হয় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। যা পরবর্তীতে যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে কাজ করে। যদিও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থায় পরোক্ষ কর হিসেবে ভ্যাট নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু এই একটি খাত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চেহারাই পরিবর্তন করে দেয়।

ভ্যাট থেকে রাজস্ব আয় বাড়ার ফলে সরকার জাতীয় বাজেটের আকারও বাড়াতে থাকে। এর ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে ৭ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার এনবিআর রাজস্ব আয় বেড়ে হয় ১১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। আর, তৃতীয় মেয়াদে সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয় ৩৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এখন রাজস্ব সংগ্রহ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন, মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদ কর-জিডিপি অনুপাত ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।

ভ্যাটের পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছিল খালেদা জিয়া সরকার। গ্রহণ করা হয় উদার নীতি। সহজ হয় আমদানি লাইসেন্স, ধাপে ধাপে কমানো হয় শুল্কহার। এতে বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ে। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৯১ সালে জাতীয় বাজেট ছিলো ১৪ হাজার কোটির কাছাকাছি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা ২৪ হাজার ৭০৭ কোটি টাকায় পৌঁছায়। তৃতীয় মেয়াদে ২০০২-০৩ অর্থবছরের বাজেট ছিল প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি তৈরি পোশাক খাত। এর অগ্রযাত্রার গতি বেড়েছিল মূলত খালেদা জিয়া প্রথম বার যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখনই। ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা, বন্ড সুবিধায় আমদানি, করপোরেট কর কমানো, নগদ প্রণোদনা দেয়া, রপ্তানি প্রক্রিয়করণ এলাকা-ইপিজেড স্থাপনসহ বিভিন্ন নীতিগত সহায়তায় এগিয়ে যায় এই খাত।

তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে বেড়ে হয় ৩.৮৫ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় মেয়াদের প্রথম অর্থবছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় শেষ অর্থবছরে বেড়ে হয় প্রায় সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার। শুধু রপ্তানি বৃদ্ধি নয় তৈরি পোশাক খাতে ৪০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়। যার অর্ধেকের বেশি নারী। কর্মক্ষেত্রে নারীদের এই অংশগ্রহণ দেশের পুরো সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে।

গার্মেন্টসকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার সময়ই বাংলাদেশের শিল্পখাতের অগ্রগতি। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়তে থাকে। তার প্রথম মেয়াদে গঠিত হয় বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড। বিনিয়োগ বাড়ায় তরুণ বেকারদের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। অন্যদিকে দেশের বাইরে জনশক্তি রপ্তানির গতি খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদেই বৃদ্ধি পায়। মালয়েশিয়ার মত নতুন বাজার উন্মুক্ত হয়।

এই ধরনের উদ্যোগের ফলে বেগম জিয়ার প্রথম মেয়াদের ৫ বছরে জনশক্তি রপ্তানি হয় প্রায় ১০ লাখ। আর, ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয় প্রথম বারের মত ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। তার তৃতীয় মেয়াদের ৫ বছর জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল ১৬ লাখের বেশি। রেমিট্যান্স আয় ৬ বিলিয়নের রেকর্ড ছুঁই ছুঁই করছিল।

১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি চালু করেন। প্রণনয়ন করা হয় বেশ কিছু আইন। প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে সেসময় অনুমোদন দেয়া হয় কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। তার সময় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে সুশৃঙ্খল করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন’। ১৯৯৩ সালে অনুমোদন দেয়া হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন। তার প্রথম মেয়াদে বেসরকারি খাতে অনুমোদন পায় দ্বিতীয় প্রজন্মের ৮টি ব্যাংক। তৃতীয় মেয়াদে জোর দেয়া হয় খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কারে। ২০০৩ সালে প্রবর্তন করা হয় অর্থঋণ আদালত আইন। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আইনটি।

চার দলীয় জোট সরকারের আমলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নতুন কোনো ব্যাংকের অনুমোদন না দেয়ার। ফলে এ সময়ে নতুন করে কোনো ব্যাংক অনুমোদন পায়নি। যদিও ২০০৯ থেকে বিগত সরকারের ১৫ বছর ছিল একেবারে ভিন্ন চিত্র। এ সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয় ব্যাংকের লাইসেন্স। যেগুলোতে পরবর্তীতে সরকারি সহায়তাতেই লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।

তরুণদের বেকারত্ব ঘুচাতে খালেদা জিয়া বাজার ভিত্তিক অর্থনীতি প্রবর্তন ও বেসরকারি খাতের বিকাশে সবচেয়ে বেশি জোর দেন। এর অংশ হিসেবে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মূলধন সংগ্রহে গুরুত্ব দেয়া হয় পুঁজিবাজারকে। তাইতো প্রথম মেয়াদেই প্রণনয়ন করেছিলেন ‘সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন-১৯৯৩’।

আপোষহীন নেত্রীর হাত ধরে অর্থনীতির যে অগ্রযাত্রা, তার ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। এখন স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পথে। তবে, বিগত ১৫ বছরের সরকার দেশকে ঋণ নির্ভর, কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধির যে মধ্য আয়ের অর্থনীতির ফাঁদে ফেলে গেছে, সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে গণতান্ত্রিক যাত্রা টেকসই করার দিকেই জোর দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ইআরএফ


   আরও সংবাদ