ঢাকা, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১০ রবিউল সানি ১৪৪৬

ওবায়দুল কাদেরদের বাড়িতে লোডশেডিংকে স্বাগতম



ওবায়দুল কাদেরদের বাড়িতে লোডশেডিংকে স্বাগতম

২০১৯ সালের শেষের দিকে সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেন ফিনল্যান্ডের ৩৪ বছর বয়সী এক নারী। ওই বয়সে ইউরোপের উন্নত দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড গড়েন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা সানা ম্যারিন। সে সময় ‘পুঁচকে’ এক মেয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে নানানজন নানান কথা বললেও সানা বলেছিলেন, ‘আমি কখনো নিজের বয়স এবং আমি নারী না পুরুষ, এসব নিয়ে ভাবিনি।’ সত্যিই তাই। এসব ভাবলে নিশ্চয়ই এই বয়সে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না তিনি। কারণ, খুব ছোটবেলা থেকেই তার চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। সানার লেখা ব্লগ থেকে জানা যায়, পড়াশোনার পাঠ চুকানো তার জন্য সহজ ছিল না। খুব ছোটবেলায় তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়েছিল। কারণ, সানার বাবা ছিলেন মাদকাসক্ত।

টাকা পয়সার অভাবে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই কাজে নেমে পড়েন সানা। গ্রীষ্মের ছুটিতে এক বেকারিতে কাজ করেন। শুধু তাই নয়, হাইস্কুলে পড়ার সময়ও কাজ করেছেন। অতিরিক্ত আয়ের জন্য ম্যাগাজিন বিলি করতেন।

এসব লেখার কারণ, নতুন করে এই ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। আলোচনা না লিখে সমালোচনা লিখলেই বরং যুতসই হবে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া এক  ভিডিওতে সানা মারিনকে তার বন্ধু ও তারকাদের সঙ্গে পার্টিতে গানের সঙ্গে সুর মেলাতে এবং গাইতে দেখা গেছে। ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। সানার বক্তব্য, আমি বন্ধুদের সঙ্গে একটা সন্ধ্যা কাটাচ্ছিলাম। আর যেখানে ভিডিও করা হয় সেখানটা ব্যক্তিগত একটা জায়গা। কিন্তু, সমালোচনা থেমে থাকেনি। অনেকেই তখন দাবি করেন, ওই পার্টিতে সানা বা তার বন্ধুরা মাদক নিয়েছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। বিরোধী দলগুলো, এমনকি ক্ষমতাসীন জোট শরিকরাও সানাকে মাদক পরীক্ষার আহ্বান জানান। পত্রপত্রিকায়ও ব্যাপক লেখালেখি হয়। জবাবে সানা জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে তিনি অত্যন্ত গুরুতর বলে মনে করেন। যদিও মাদক পরীক্ষার দাবিকে তিনি অন্যায্য বলে মনে করেন কিন্তু নিজের আইনি সুরক্ষার জন্য এবং মানুষের মন থেকে যেকোনো ধরনের সন্দেহ দূর করার জন্য (১৯শে আগস্ট) তিনি মাদক পরীক্ষা করতে দিয়েছেন।

আমিতো বলি মন্ত্রীর বাড়িতেও লোডশেডিং করা হোক। প্রধানমন্ত্রী এটা করলে আমি তাতে সমর্থন দেবো। আমাদের মন্ত্রীদের বাড়িতেও লোডশেডিং হতে পারে। জনগণের বাড়িতে লোডশেডিং হলে মন্ত্রীর বাড়িতে, এমপির বাড়িতে কেন হবে না। যেটা যুক্তিযুক্ত সেটাই আমাদের করা উচিত।’

তিনদিন পরই সানার মাদক পরীক্ষার ফল ‘নেগেটিভ’ আসে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা আইডা ভালিন জানান, মারিনের প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল সেখানে কোকেন, অ্যামফেটামিনেস, গাঁজা এবং ওপিওডসের উপস্থিতি আছে কিনা। অবশ্য সানা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন যে, পার্টিতে তিনি কেবল অ্যালকোহল পান করেছেন, কোনো ধরনের মাদক নেননি। তাছাড়া, পার্টিতে অংশগ্রহণকারী কাউকেও তিনি মাদক নিতে দেখেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে কখনো, এমনকি তরুণ বয়সেও কোনো মাদক নেইনি।’ আগেই বলা হয়েছে, সানার বাবার মাদকাসক্তির কারণেই তার মা আলাদা হয়েছিলেন।

অবশ্য সানা মাদক নেননি, এটা প্রমাণিত হওয়ার পরও সমালোচনা থেমে থাকেনি। সমালোচকরা তখন প্রশ্ন করতে থাকেন, ফিনল্যান্ড যদি হঠাৎ কোনো সংকটে পড়ে যেতো তাহলে পার্টি করার কারণে সানার দ্রুত ওই সংকট মোকাবিলায় দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যাঘাত ঘটতো কিনা? সানাকে তখন এটাও নিশ্চিত করতে হয় যে, পার্টিতে থাকলেও তিনি তার সরকারি দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতিতে অটুট ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজের প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে পার্টি থেকে বের হয়ে আসার সক্ষমতা তার ছিল।

ইউরোপের দেশে ৩৬ বছর বয়সী এক মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে সামান্য নাচ-গান করা নিয়ে এত সমালোচনা! ভাবতেই অবাক লাগে, তাই না? কিন্তু, এখানে আসলে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। ফিনল্যান্ড একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারই সবকিছু নয়। বিরোধীদল, বিরোধী মত, গণমাধ্যম এসব কিছুই গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। যে কারণে নিজে নির্দোষ জানা স্বত্ত্বেও বিরোধী মতকে সম্মান জানাতেই তাদের অন্যায্য আবদার মেনে নিয়ে সানা মাদক পরীক্ষা করিয়েছেন। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক হলেও আমরা কী ওই একই চিত্র দেখতে পাই? 

বিভিন্ন সময়ে আমরা সরকারের অতি উচ্চ পদে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাধারণ জনগণের মতামতকে, বিরোধী (যৌক্তিক) মতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য এমনকি অবজ্ঞা করতেও দেখতে পাই। এ প্রসঙ্গে নিকট অতীতের একটি ঘটনা খুব মনে পড়ছে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ফের ক্ষমতায় এলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান সৈয়দ মহসিন আলী। ক্ষমতা পেয়ে ওই মাসেই ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন তিনি। ২৭শে জানুয়ারি সিলেটে বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে জেএসসি ও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কোমলমতি শিশুদের সামনেই মঞ্চে বসে প্রধান অতিথি মহসিন আলী প্রকাশ্যে ধূমপান করেন। ওই সময় তার পাশেই বসা ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি বিজিবি সিলেট সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. জামাল মাহমুদ সিদ্দিক, বিশেষ অতিথি মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, জেলা পরিষদের প্রশাসক আবদুজ জহির চৌধুরী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রুহুল আনাম, কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফয়জুল হক প্রমুখ।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ, বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ, গণপরিবহনে ধূমপান করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও কোমলমতি শিক্ষার্থী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে মন্ত্রীর এহেন আচরণে উপস্থিত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সেদিন চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। মন্ত্রীর ধূমপানের ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন পত্রিকাতে প্রকাশিত হলে তীব্র সমালোচনার মুখে মন্ত্রী তার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, অবচেতন মনেই শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি ধূমপান করে ফেলেছেন। এ ঘটনার জন্য তিনি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।

কিন্তু, মন্ত্রী মুখে ক্ষমা চাইলেও তার কথায় ও কাজে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। পরের বছর আবারো প্রকাশ্যে ধূমপান করেন তিনি, তাও আবার সেই কোমলমতি শিশুদের সামনেই! সেদিন (২৭শে আগস্ট) মন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারের (বালিকা) এতিমদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা চলাকালে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয়ার প্রাক্কালে সভামঞ্চেই প্রকাশ্যে সিগারেট টানতে শুরু করেন। সেখানে কর্তব্যরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীদের মন্ত্রীর সঙ্গে থাকা জনসংযোগ কর্মকর্তা ও দেহরক্ষীরা ছবি তুলতে বাধা দেন এবং তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এর আগেই সিলেটে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে মন্ত্রী বলেছিলেন, সতর্ক হয়ে যান, বউ নিয়ে ঘরে ঘুমাতে পারবেন না। ওই অনুষ্ঠানে তিনি সংবাদকর্মীদের ‘খবিস’ বলে গালি দিতেও ছাড়েননি।

মহসিন আলীর ঘটনাগুলোর বিপরীত চিত্রও অবশ্য রয়েছে। মহসিন আলী যে মন্ত্রিসভায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন, ঠিক একই মন্ত্রিসভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তারানা হালিম। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বার কয়েক রাজধানী ঢাকায় লোকাল বাসে চড়ে আলোচনার জন্ম দেন। ১২ই সেপ্টেম্বর গুলিস্তান থেকে ৬ নম্বর বাসে করে তিনি গুলশান পৌঁছান। প্রতিমন্ত্রী সেদিন জানিয়েছিলেন, এ যাত্রা কেবল একদিনের জন্য নয়। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া বাকি সময় সরকারি গাড়ি বাদ দিয়ে লোকাল বাসেই যাতায়াত করবেন। বাসে চড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তারানা হালিম বলেছিলেন, ফেসবুকে একটা বাচ্চা লিখেছিল- আমরা পাবলিক বাসে উঠি না কেন? উঠলাম ব্যাটা! আজ  থেকে প্রতিদিন অফিসে যাবো পাবলিক বাসে, ফিরবো পাবলিক বাসে। অ্যান্ড ইটস অ্যা প্রমিজ, যা আমি রাখবো। কদিন পর (১৬ই সেপ্টেম্বর) তারানা হালিম ফের লোকাল বাসে করে গুলশানের বাসা থেকে পল্টন নেমে সচিবালয়ে যান। এরপর নিজ কথামতো তারানা হালিমের নিয়মিত পাবলিক বাসে চড়ার দৃশ্য আর চোখে পড়েনি। এক সময় টিভি নাটকের তুখোড় অভিনেত্রী তারানা হালিমের পাবলিক বাসে চড়াটাও নেহায়েত অভিনয় ছিল কিনা সে সময় এ নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন। সে যাই হোক, অনেক গণতান্ত্রিক উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়মিতিভাবে গণপরিবহনে চড়ার খবর আমরা নিয়মিতভাবেই পেয়ে থাকি।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য নিঃসন্দেহে স্বাগত জানানোর মতো। মঙ্গলবার (২৩শে আগস্ট) সচিবালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমিতো বলি মন্ত্রীর বাড়িতেও লোডশেডিং করা হোক। প্রধানমন্ত্রী এটা করলে আমি তাতে সমর্থন দেবো। আমাদের মন্ত্রীদের বাড়িতেও লোডশেডিং হতে পারে। জনগণের বাড়িতে লোডশেডিং হলে মন্ত্রীর বাড়িতে, এমপির বাড়িতে কেন হবে না। যেটা যুক্তিযুক্ত সেটাই আমাদের করা উচিত।’

জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশের সর্বত্র এখন নিয়মিতভাবে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। সারা দেশে এলাকাভিত্তিক দিনে একঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সময়সূচি দেয়া হলেও বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে দুই-তিন ঘণ্টা বা ক্ষেত্র বিশেষে তারও বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। আর প্রামাঞ্চলে কখন বিদ্যুৎ যায় আর কখন আসে সেটা বোঝাই মুশকিল। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে এই প্রচণ্ড গরমে সাধারণ মানুষের জীবন যখন দারুণভাবে বিপর্যস্ত তখন ওবায়দুল কাদেরের কথামতো এমপি-মন্ত্রীদের বাড়িতেও লোডশেডিং করা হলে তারা কিছুটা হলেও হয়তো জনগণের অবর্ণনীয় কষ্ট অনুধাবন করতে পারবেন।


   আরও সংবাদ